চলমান রফতানি ক্রয়াদেশ স্থগিত করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা

 Published in: Bonik Barta on April 6, 2025
চলমান রফতানি ক্রয়াদেশ স্থগিত করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা

যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কারোপের প্রভাব বেশি পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাতে | ছবি: বনিক বার্তা

হোয়াইট হাউজে ২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে নতুন রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় এ ঘোষণার সময় বাংলাদেশে তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ২টার ঘরে। ভোর হতে না হতেই যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রফতানিকারক এক বাংলাদেশী শিল্পোদ্যোক্তার কাছে ই-মেইল আসে। মার্কিন ক্রেতার পক্ষ থেকে আসা সেই ইলেকট্রনিক বার্তায় ক্রয়াদেশের নতুন পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়।

ই-মেইলটি বণিক বার্তার হাতে এসেছে। তাতে লেখা রয়েছে, ‘আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রভাব মূল্যায়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত অনুগ্রহ করে কোনো নতুন উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা থেকে বিরত থাকুন।’

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের বাণিজ্যের আকার ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের অর্থমূল্য ২ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আর বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে রফতানি পণ্যের অর্থমূল্য ৮ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, যার ৮৭ শতাংশই আবার তৈরি পোশাক পণ্য। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্পের নতুন শুল্ক-খড়্গের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের পোশাক রফতানিতে। বিষয়টি নিয়ে তাই সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারক কারখানা মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন ক্রেতারা। রফতানিকারক কারখানা কর্তৃপক্ষও মার্কিন ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুল্কের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে ক্রেতাদের পক্ষ থেকেই যোগাযোগ করা হচ্ছে রফতানিকারকদের সঙ্গে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র অনুযায়ী, মার্কিন পোশাক ক্রেতাদের মধ্যে কেউ কেউ এরই মধ্যে ঘোষিত নতুন শুল্ক কাঠামোর সম্ভাব্য প্রভাব মূল্যায়ন শুরু করে দিয়েছেন। সে অনুযায়ী কারখানা মালিকদের জন্য দিকনির্দেশনাও আসতে শুরু করেছে। কোনো কোনো ক্রেতার পক্ষ থেকে আবার আরোপিত নতুন শুল্ক রফতানিকারকদেরই পরিশোধ করতে বলা হচ্ছে। তাছাড়া নতুন ক্রয়াদেশ বাতিলসহ চলমান উৎপাদন স্থগিতের নির্দেশনাও আসতে শুরু করেছে।

পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ালমার্ট বাংলাদেশে তাদের কিছু পোশাক সরবরাহকারী কারখানা কর্তৃপক্ষকে ৩৭ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে বলেছে। এছাড়া সরবরাহকারীদের ওপর শুল্ক পরিশোধের চাপ দিতে শুরু করেছে আরেক মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান গ্যাপ। ক্রেতা ও পোশাক সরবরাহকারীর সম্পর্ক অটুট রাখতে বেশির ভাগ কারখানা মালিকই অবশ্য এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো কোনো ক্রেতা উৎপাদন স্থগিত রাখতে বলেছে, আবার কেউ কেউ ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে। তাছাড়া শুল্ক বাড়ায় কিছু ব্র্যান্ডপণ্যের মূল্য ট্যাগ পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে বলে শিপমেন্ট পিছিয়ে দিতে বলছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (ওটিইএক্সএ) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭২৮ কোটি ডলারের পোশাক বাংলাদেশ থেকে আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে বেড়ে যার পরিমাণ হয়েছে ৭৩৪ কোটি ডলারের কিছু বেশি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি করেছে ১৫০ কোটি ডলারের কিছু বেশি, যা ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি।

তৈরি পোশাক পণ্যের আরেক সংগঠন বিকেএমইএ নেতারাও চলমান ক্রয়াদেশ নিয়ে ঝুঁকির প্রসঙ্গটি স্বীকার করেছেন। সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার নিজের কারখানায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য উৎপাদন চলমান নেই। তবে অন্যদের ক্ষেত্রে স্থগিতের বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমার পরিচিত একজন আমদানিকারক, যার দুটি কনটেইনার ৯ এপ্রিল, আরেকটি কনটেইনার ১২ এপ্রিল নিউইয়র্কে পৌঁছার কথা। কিন্তু ক্রেতা তাকে সেগুলো “হোল্ড” করতে বলেছেন।’

ঘোষিত নতুন শুল্কের তাৎক্ষণিক প্রভাব মোকাবেলা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে ফজলুল হক বলেন, ‘যে কনসাইনমেন্টগুলো যুক্তরাষ্ট্রের পথে রয়েছে, যে কনসাইনমেন্টগুলো নেগোসিয়েশন পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ ক্রেতারা ওই কনসাইনমেন্টগুলোর ক্ষেত্রে ডিসকাউন্টসহ নানা রকম শর্ত চাপিয়ে দিতে পারেন বলে শঙ্কা রয়েছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করছি বাড়তি শুল্কের একটা অংশ ক্রেতারা নিজেরা বহন করবে। বাকিটা আমাদের মতো উৎপাদকদের দিকে ঢেলে দেবে। পাল্টা শুল্কের চাপে মার্কিন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের ওপর প্রথমেই পোশাকের দাম কমানোর চাপ তৈরি করতে পারে। এখন আমাদের হাতে যেসব ক্রয়াদেশ আছে, সেগুলোর দামও কমাতে বলতে পারে ক্রেতারা।’

পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য এও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ সাধারণত কম দামের বা মৌলিক পোশাক বেশি রফতানি করে থাকে, যেগুলো খুবই মূল্যসংবেদনশীল। মৌলিক পোশাকের প্রতিযোগিতাও তুলনামূলক বেশি। ফলে রেসিপ্রোকাল বা পাল্টা শুল্ক আরোপের পরও ভোক্তা পর্যায়ে ওই সব পোশাকের মূল্যবৃদ্ধির শঙ্কা তুলনামূলক কম। কারণ দাম বাড়ালে বিক্রি কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যই ক্ষতিকর হবে।

বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, পোশাক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে হেডগিয়ার, জুতা, অন্যান্য বস্ত্রপণ্য, পালক এবং পালকের তৈরি সামগ্রী, ওষুধ, চামড়াজাত পণ্য, মাছ, শস্যদানা, আসবাব প্রভৃতি।

Posted on